আকর্ষণ হারাচ্ছে জাতীয় জাদুঘর, কমছে দর্শক

ঢাকায় বেড়াতে আসা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের কাছে একসময় জাতীয় জাদুঘর ছিল আকর্ষণীয় একটি স্থান। কিন্তু এখন সেই আকর্ষণ আর তেমন নেই। গত পাঁচ বছরে এখানে দর্শনার্থীর সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব জাদুঘর দিবস।
আন্তর্জাতিক জাদুঘর কাউন্সিল (আইকম) প্রতি বছর ১৮ মে এই দিবসটি উদযাপন করে। এবারের প্রতিপাদ্য— ‘দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে জাদুঘরের ভবিষ্যৎ’। দিবসটি উপলক্ষে সকাল ১০টায় জাতীয় জাদুঘরের সামনে একটি শোভাযাত্রা, সেমিনার এবং নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে বিশেষ প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
জাতীয় জাদুঘর দর্শনার্থী সংখ্যা কমার চিত্র
এক দশক আগেও জাতীয় জাদুঘরে বছরে গড়ে ছয় লাখ দর্শনার্থী আসতেন। ২০১৮-১৯ সালে দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৩০ হাজার ৩৩ জন। পরের বছর তা কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ১৪ হাজার ৫৮৯ জনে। ২০২০-২১ সালে এই সংখ্যা আরও নেমে আসে ১ লাখ ১৪ হাজার ৩০৪ জনে। করোনা মহামারি এ ক্ষেত্রে একটি বড় কারণ। ২০২২-২৩ সালে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়ে ৪ লাখ ৩৪ হাজার হলেও পরের বছর তা আবার কিছুটা কমে যায়।
জাতীয় জাদুঘরে কী আছে?
১৯১৩ সালে ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৯৮৩ সালে শাহবাগে বর্তমান ভবনে এর কার্যক্রম শুরু হয়। এখানে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় মোট ৪৬টি গ্যালারিতে নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে। জাতীয় জাদুঘরের সচিব মো. সাদেকুল ইসলাম ও জনশিক্ষা বিভাগের কিপার আসমা ফেরদৌসী জানান, বর্তমানে জাদুঘরে ১ লাখ ১৯ হাজারেরও বেশি নিদর্শন সংরক্ষিত আছে, তবে দর্শকদের জন্য মাত্র পাঁচ হাজার নিদর্শন প্রদর্শন করা হয়।
নিদর্শনগুলো চারটি বিভাগে সাজানো:
১. প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ: ভূতাত্ত্বিক নিদর্শন, ভৌগোলিক তথ্য ইত্যাদি।
২. জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা বিভাগ: আদিবাসী সম্প্রদায়ের ইতিহাস, পোশাক, অলংকার, লোকশিল্প ইত্যাদি।
৩. ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্প বিভাগ: প্রাচীন মূর্তি, ভাস্কর্য, মুদ্রা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মারক।
৪. সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসাহিত্য বিভাগ: জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, এসএম সুলতানসহ শিল্পীদের চিত্রকলা ও ভাস্কর্য।
এছাড়াও, জাদুঘরে কিছু অত্যন্ত দুর্লভ নিদর্শন রয়েছে, যেমন:
- ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের বিষ্ণু ও বুদ্ধমূর্তি
- নবাব সিরাজউদ্দৌলার তরবারি ও গালিচা
- দুই লাখ বছরের পুরনো গাছের জীবাশ্ম
- মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় স্মারক
দর্শকদের মতামত
ময়মনসিংহ থেকে আসা নুরুল মোমেন ও তার পরিবার বলেন, “জাদুঘরে বসার ব্যবস্থা কম, বাচ্চাদের আকর্ষণ করার মতো বিশেষ কিছু নেই।” অন্যদিকে, ঢাকার সামিউল ইসলাম বলে, “প্রাচীন মূর্তি ও আদিবাসীদের জীবনযাত্রার মডেলগুলো আমার খুব ভালো লেগেছে।”
আকর্ষণ কমার কারণ
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একই নিদর্শন দীর্ঘদিন ধরে প্রদর্শন, প্রচারের অভাব এবং দক্ষ জনবলের সংকট জাদুঘরের জনপ্রিয়তা কমার মূল কারণ। জাতীয় জাদুঘরের কিপার আসমা ফেরদৌসী স্বীকার করেন, “জাদুঘরের মার্কেটিংয়ে কিছু ঘাটতি আছে।”
পরিচালনায় সংকট
জাদুঘরের ছয়টি বিভাগের মধ্যে মাত্র দুটিতে নিয়মিত কিপার রয়েছেন। গত কয়েক বছরে মহাপরিচালক ও সচিব পদে ঘনঘন পরিবর্তন হয়েছে, যা জাদুঘরের কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে।
জাতীয় জাদুঘরের আওতাধীন অন্যান্য জাদুঘর
জাতীয় জাদুঘর শুধু শাহবাগের মূল ভবনই নয়, আহসান মঞ্জিল, জিয়া স্মৃতি জাদুঘর (চট্টগ্রাম), ওসমানী স্মৃতি জাদুঘর (সিলেট), জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা (ময়মনসিংহ) সহ দেশের আরও কয়েকটি জাদুঘর পরিচালনা করে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানও গতানুগতিকভাবে চলছে।
সমাধানের উপায়
আইকম বাংলাদেশের সাবেক কিপার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “জাতীয় জাদুঘরকে আকর্ষণীয় করতে আধুনিকায়ন ও দক্ষ জনবল তৈরি জরুরি। নিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শনে বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন।”
সর্বোপরি, জাদুঘরকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিতে হলে নিত্যনতুন প্রদর্শনী, ইন্টারেক্টিভ ব্যবস্থা এবং প্রচারণা জোরদার করা প্রয়োজন।