পালাবদলের নতুন বাঁকে রাজনীতির মঞ্চ-২০২৪

জুলাই আন্দোলনের সফলতার পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন এক পর্যায়ে প্রবেশ করে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীরা এখন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছেন।
তাদের মতে, গত ৫৩ বছরের প্রচলিত রাজনীতি সমাজকে বিভেদের মধ্যে রাখে; বর্তমানে তাদের লক্ষ্য বিভিন্ন মত ও বিশ্বাসের মানুষকে একত্রিত করে একটি নতুন রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি করা।
এই উদ্দেশ্যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়, যেখানে তারা ১৯৭২-এর সংবিধান ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বলে উল্লেখ করে।
২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই ঘোষণাপত্র প্রকাশের কথা ছিল। তবে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়নের আশ্বাস দেওয়ায় নেতারা তাদের কর্মসূচি পরিবর্তন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ১৯৭২-এর সংবিধান নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বস্তিতে থাকা বিএনপির জন্য অস্বস্তি তৈরি করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস মন্তব্য করেছেন, “১৯৭২-এর সংবিধানকে কবর দেওয়ার কথা শুনে আমরা মর্মাহত। যদি এই সংবিধানে কোনো ত্রুটি থেকে থাকে, তা অবশ্যই সংশোধনযোগ্য।”
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দেড় দশকের শাসনের অবসান ঘটিয়ে, একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে তরুণরা অগ্রণী ভূমিকা রাখতে চায়।
একটি দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
আওয়ামী লীগের “ফ্যাসিবাদী শাসন” ব্যবস্থাকে চিরতরে উৎখাত করার পাশাপাশি, যাতে কোনো কর্তৃত্ববাদী শক্তি ভবিষ্যতে জনগণের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, সে জন্য ক্ষমতার রূপান্তরের পর গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে সচেষ্ট।

গণআন্দোলনের জোয়ারে আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের বিতর্কিত শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর দলের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে রয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপ’-এর অভিযোগে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আন্দোলনকালীন হত্যা, গণহত্যা, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি ও দলের ঊর্ধ্বতন নেতারা।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বিচারপ্রক্রিয়া শেষে দলটি রাজনীতিতে ফিরতে পারবে কিনা—বা কীভাবে ফিরবে—সে বিষয়ে আলোচনা চলছে। এমনকি আগামী নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়িত্বভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়। তবে এ লক্ষ্যে সরকার ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
সংস্কার প্রক্রিয়া কে নেতৃত্ব দেবে—এ নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিএনপি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব পেশ করেছে। জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলও তাদের সংস্কার পরিকল্পনা তুলে ধরেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের চার মাস পেরিয়ে গেলেও নির্বাচনের রোডম্যাপ এখনো ঘোষণা করা হয়নি। তবুও রাজনৈতিক মহলের আশা, ২০২৫ সাল দেশের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনবে।
বর্তমান রাজনৈতিক সমীকরণ ও জনমত বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, নতুন বছরটি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে পারে।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো এখন যে সংস্কারের কথা বলছে, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও সেগুলো বাস্তবায়ন না করায় এ ধরনের সংস্কার এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।
তিনি আরও বলেন, “২০২৬ সালের শুরুতে নির্বাচন হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে শুধু নির্বাচন দিলেই যে আমরা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারব, তা আমি মনে করি না। আমাদের নীতিগত অবস্থান ও সচেতনতা গড়ে তোলার কাজও করতে হবে।”
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের নতুন চিন্তা
জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা করছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রনেতারা বলছেন, ভিন্ন চিন্তা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত এই দলের মূল লক্ষ্য হবে জনগণের আস্থা অর্জন।
‘জনশক্তি’ নামে একটি দল গঠনের খবর আসার পর জাতীয় নাগরিক কমিটি জানিয়েছে, এই নামে দল গঠনের কোনো সিদ্ধান্ত বা আলোচনা হয়নি।
তবে সম্প্রতি পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে সারজিস আলম বলেছেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে একাধিক নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করতে পারে। তার এই মন্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন দলের আগমনের সম্ভাবনাকে আরও জোরালো করেছে।
দলের নাম এখনো ঘোষণা করা না হলেও উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরউদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, “এই দলটি সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচের হবে। এখানে সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদী কাঠামোর কোনো স্থান থাকবে না। তারা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জনআকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে কাজ বা বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে হাঁটবে না।”

রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা” পূরণের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি স্পষ্টভাবে কোনো উত্তর দেননি।
নাসীরুদ্দীন বলেন, “গত ৫৩ বছরের রাজনৈতিক চর্চা একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছিল। এই ব্যবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য বাংলাদেশের মানুষ ব্যাকুল ছিল। তাই তারা মাঠে নেমে এসেছিল। ভবিষ্যতে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গড়ে উঠবে, তাতে এই মানুষদের অংশগ্রহণ থাকবে। আমরা সবাই একসাথে কাজ করব। যত দ্রুত সম্ভব আমাদের লক্ষ্যগুলো একত্র করতে পারব, তত দ্রুতই আমরা অগ্রগতি অর্জন করব।”
এই নতুন রাজনৈতিক দলটি কেমন হবে? ছাত্রনেতাদের মতে, তারা প্রচলিত রাজনৈতিক ধারা থেকে ভিন্ন কিছু উপস্থাপন করবেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, “নতুন রাজনৈতিক দলটি শুধু কথায় সীমাবদ্ধ থাকবে না—কাজের মাধ্যমে তাদের প্রমাণ করতে হবে। দলটিকে জনগণের প্রত্যাশা বুঝতে হবে। অতীতে ক্ষমতাসীন দলগুলো জনগণের চাহিদা উপেক্ষা করে শুধু ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছে। আমরা আশা করি, এই দল সেরকম হবে না।”
নতুন এই রাজনৈতিক উদ্যোগে কোন আদর্শ স্থান পায়, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। তবে, গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন এবং বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষের একত্রিত হওয়াকে অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
সাবেক ছাত্রনেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মুশতাক হোসেন বলেন, “তারা যদি এমন কোনো নতুন রাজনীতি নিয়ে আসে, যা পুরোনো রাজনৈতিক পরিচয়কে অতিক্রম করতে পারে, সেটি দেখার বিষয়। এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। এখন দেখার বিষয় হলো, তারা কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দর্শন সামনে আনছে। কারণ, আগে যারা বিপরীত মতাদর্শে ছিল, এখন তারা একসাথে আছে। আন্দোলনে বিভিন্ন মতের মানুষের একত্রিত হওয়া নতুন নয়, কিন্তু একটি রাজনৈতিক দল যদি সত্যিকারের ঐক্য গড়ে তুলতে পারে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সেটিই দেখতে চাই।
রুণদের নতুন দল গঠন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খোর্শেদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,
“জুলাইয়ের পরবর্তী সরকারকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক হতে হবে। এ বিষয়ে কোনো ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ চলবে না। কারণ, জুলাই অভ্যুত্থানের মূল চেতনাই ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। যেসব ছাত্র ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, তাদের হাত দিয়েই নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হতে পারে। তবে এই দল যেন ‘কিংস পার্টি’-তে পরিণত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, তাদের মাথার উপর এই সরকার বেশি দিন টিকবে না।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী বদর উদ্দিন বলেন,
“১/১১-এর সময় মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার ‘কিংস পার্টি’ তৈরি করে রাজনীতিবিদদের বাদ দেওয়ার নীতি (টু-মাইনাস থিওরি) বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু জনগণ সেই নীতি প্রত্যাখ্যান করেছিল, ফলে কিংস পার্টিও টিকতে পারেনি। আজ আবার একই ধরনের চেষ্টা শোনা যাচ্ছে—গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নতুন দল গঠনের কাজ চলছে।”
আওয়ামী লীগের সামনে অনিশ্চয়তা
গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতা হয় বিদেশে পালিয়েছেন, নয়তো গ্রেপ্তার হয়েছেন। বেশিরভাগ নেতা এখন আত্মগোপনে। ঢাকার ধানমণ্ডি ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের দলীয় কার্যালয়গুলো এখন পরিত্যক্ত। সারাদেশে দলীয় অফিসগুলো হয় দখল হয়ে গেছে, নয়তো ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটিও এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে যা দেখা যায়নি, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ তা প্রত্যক্ষ করেছে। তখন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা ছাড়লেও পালিয়ে যাননি, বরং অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয় ক্ষমতাচ্যুত জাতীয় পার্টি। এই দলটি গড়ে তুলেছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, যিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর।
কিন্তু আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে সরব হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের অভিযোগ, বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া মানে আন্দোলনে শহিদ ছাত্র-জনতার রক্তের সাথে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করা।
তবুও, শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্য থেকে সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, তারা রাজনীতিতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
১৫ আগস্ট ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে দলের নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হন।
গত নভেম্বরে নূর হোসেন দিবসে মাঠে নামার ঘোষণা দিলেও আওয়ামী লীগকে পিছু হটতে হয় গণঅভ্যুত্থানপন্থী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর প্রতিরোধের মুখে।
ফলে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ যে সংগ্রামী চেতনা নিয়ে পুনরায় মাঠে নামে, এবারের পরিস্থিতি তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
পুরান ঢাকার বংশালে আওয়ামী লীগের অবস্থান নিয়ে সমর্থকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
পুরান ঢাকার বংশাল মোড়ের একটি হার্ডওয়্যার দোকানের কর্মী শফি মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বংশালে এমন কিছু আওয়ামী লীগার আছেন যারা অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে সম্পদশালী হয়েছেন। এখন তারা দলের পরিচয় দিতে ভয় পান।”
ষাটোর্ধ্ব শফি মিয়া আরও বলেন, “তবে আমরা যারা দলের সাধারণ কর্মী বা সমর্থক, যারা তেমন সুবিধা পাননি, তারা বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগ আবারও সংস্কার হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে।”
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা অভিযোগ করছেন, দলের নেতা-কর্মীদের ভীত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের প্রক্রিয়া, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের রিমান্ডে নেওয়া এবং আদালতে হয়রানির মতো ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।
তবে দলের সমর্থক ও শান্তিনগরের বাসিন্দা এইচএম ইসহাকের মতে, এসব ঘটনায় বরং আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের সহানুভূতি বাড়ছে।
রাজনীতিতে দলের পুনরুত্থান সম্পর্কে আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, “বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের মতো বড় দলকে বাদ দিয়ে কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা অতীতের মতোই আবার শক্তিশালী হয়ে উঠব।

বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের বিবর্তন
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর বাংলাদেশে বহুদলীয় রাজনীতির পথিকৃৎ হিসেবে বিএনপি নিজেদের দাবি করে। প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আমলেই জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ পায়।
১৯৯০-এর দশকের রাজনৈতিক পরিবর্তন বিএনপি ও জামায়াতকে কাছাকাছি আনে। পরবর্তীতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারেও জামায়াত গুরুত্বপূর্ণ শরিক ছিল। ২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও বিএনপির পাশে ছিল জামায়াত।
কিন্তু ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার পর থেকে দুটি দলের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। বিএনপি তখন জানায়, জামায়াতের ওপর নির্ভরতা কমানো এবং ‘বিএনপি-জামায়াত’ নামে সমালোচনা দূর করাই তাদের লক্ষ্য।
তবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সেই সম্পর্ক আর পুনরুদ্ধার হয়নি। বর্তমানে দুটি দলের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে স্পষ্ট মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে।
সংস্কার শেষ করে তারপর নির্বাচন”, “নির্বাচন নিয়ে অধিক তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়”—গত তিন মাস ধরে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা এমন বক্তব্য দিয়ে আসলেও নভেম্বর মাসের শেষে দলটির নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান “যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার সম্পন্ন করে” নির্বাচন দাবি করেছিলেন।
২১ ডিসেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে এক সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবশ্যই ২০২৫ সালের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে হবে। এই সময়ের মধ্যেই সব সংস্কার কাজ শেষ করতে হবে। আমরা আশা করি, প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবেন।”
অন্যদিকে, চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। ২৭ ডিসেম্বর ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত এক সংলাপে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “সংস্কার প্রক্রিয়ায় যত বেশি সময় লাগবে, সমস্যাগুলো ততই বাড়বে বলে আমাদের ধারণা।”
এছাড়াও চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ নিয়ে দুই দলের নেতাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা দেখা গেছে।
২৯ ডিসেম্বর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জামায়াতে ইসলামীকে ইঙ্গিত করে বলেন, “ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা কীভাবে ইসলামী ব্যাংক দখল করে নিল, তা জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে।”
এ বক্তব্যের জবাবে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, “জামায়াতের রাজনীতি ভারতের আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী। জাতি আমাদের এই অবস্থানকে সমর্থন করেছে। সম্ভবত এ কারণেই রিজভীর মধ্যে এমন উত্তাপ তৈরি হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাসে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে ‘ফ্যাসিস্ট’ শেখ হাসিনা সরকারকে অপসারণের আন্দোলনে জড়িত রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ‘সহযোগীরা’ নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে এই সরকারকে ব্যর্থ করতে। এটা প্রতিহত করতে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান অপরিহার্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাইসা তাব্বাসুম বলেন, “বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। আগের সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে।
এখন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনী সংস্কার শুরু করা জরুরি। অন্যথা, নতুন বছরের মধ্যে নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে—তারা দ্রুত নির্বাচন দিতে চায় কি না।”
বিএনপিসহ ৬২টি ছোট-বড় দল ও জোট তাদের সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনে জমা দিয়েছে। বিএনপির মতে, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা বাস্তবায়নে জনসমর্থন ও নির্বাচিত সংসদের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
২০২৫ সালের নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি কাটিয়ে সমঝোতা অর্জনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন কবি ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, “আমি এখন নির্বাচনের চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পুনর্মিলনকে গুরুত্ব দিই। আমরা একটি পুনর্মিলন পরিষদ গঠন করে দীর্ঘদিনের বিভক্তি ও ক্ষত নিরাময় করতে পারি। এটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
ছাত্র-জনতার রক্তঝরা সংগ্রামের পর দেশের সব রাজনৈতিক দলই একটি ‘নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের জন্য প্রতীক্ষায় আছে। তবে নীলফামারীর টুনিরহাটের নতুন ভোটার আরমান আলী স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেছে। এখন আর আগের মতো যেভাবে খুশি ভোট অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, “এবার রাজনীতির হিসাব-নিকাশে ভোটের সমীকরণ আগের মতো থাকবে না। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে হবে, কেরামতি করে ভোট নেওয়ার দিন শেষ। আমরা নতুন ভোটাররা আমাদের ভোটের মূল্য বুঝি। এবার বাকিটা আপনারা বুঝে নিন।”
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ১৭ ডিসেম্বর হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ সেই সংশোধনীর কিছু অংশ বাতিল ঘোষণা করে।
এই রায়ের ফলে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের বিধান বাতিল হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেছেন, “হাই কোর্টের রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসার পথ খুলেছে, আর এটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে সাংবিধানিকভাবে সাংঘর্ষিক হবে না।”
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হয়েছিল, যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসে। কিন্তু ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে এই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়, যাতে আওয়ামী লীগ টানা তিনবার জয়লাভ করে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দলীয় সরকারের অধীনেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯০ সালে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দলের সম্মতিক্রমে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নেন। তার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই ওই সময়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা দেশের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।